আতশবাজি ও ফানুশ মুক্ত নববর্ষ উদযাপনের অনুরোধ

আতশবাজি ও ফানুশ মুক্ত নববর্ষ উদযাপনের অনুরোধ



স্টাফ রিপোর্টার: শুক্রবার এ বিষয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন প্রদান করেন বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) এর চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার। স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ এর পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. হুমায়ুন কবির এর সঞ্চালনায় আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এম. শহিদুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন, আরন্যক ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক, ইন্সটিটিউশন অফ ফরেস্টার্স বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক রকিবুল হাসান মুকুল, বাংলাদেশ ইন্সটিউট অফ প্ল্যানার্স এর সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান, পরিবেশবিদ, গবেষক ও লেখক আশিকুর রহমান সমী এবং সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী অ্যাড. রাশেদুজ্জামান মজুমদার। সম্মেলনে মূল বক্তা হিসাবে উপস্থিত ছিল কিডস টিউটোরিয়াল স্কুলের সপ্তম শ্রেণীর শিক্ষার্থী ওয়াজিহা জামান।



ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার ২০১৭ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ৭ বছরে নববর্ষ উদযাপনের সময় ক্যাপস কতৃক পরিচালিত বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলাফল বিশ্লেষণ করে বলেন, ২০২৩ সালের নববর্ষে রাত ১১-১২টার তুলনায় পরবর্তী ১ ঘন্টার বায়ু দূষনের পরিমাণ প্রায় ৩৬% এবং শব্দদূষণ ১০২% বৃদ্ধি পেয়েছিল। অপরদিকে ২০২৪ সালের নববর্ষের রাত ১১-১২টার তুলনায় পরবর্তী ১ ঘন্টার বায়ু দূষনের পরিমাণ প্রায় ৩৫% এবং শব্দদূষণ ৪২% বৃদ্ধি পেয়েছিল। মাত্রাতিরিক্ত শব্দ ও বায়ুদূষণ মানুষ, পশু-পাখি উদ্ভিদ সহ সার্বিক প্রাণ-প্রকৃতির উপর ব্যাপক খারাপ প্রভাব ফেলছে। আতশবাজি এবং ফানুসের পরিবর্তে আলোকসজ্জা, প্রার্থনায় অংশগ্রহণ করা এবং সীমিত শব্দে দেশীয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নতুন বছর উদযাপন করা যেতে পারে। আমরা কখনই চাইনা উৎসব-আনন্দে আইনের কঠোরতার মধ্য দিয়ে পার করি। সুস্থ্য নির্মল পরিবেশই আমাদের কাম্য।


কিডস টিউটোরিয়াল স্কুলের সপ্তম শ্রেণীর শিক্ষার্থী ওয়াজিহা জামান তার ছোট জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে বলে, সব শিশুরা আতশবাজির শব্দে আনন্দিত হয় না, অনেক শিশুরা ভয়ও পায়। তাই সবার কাছে অনুরোধ বর্ষ উদযাপনে আতশবাজি না পুড়িয়ে অন্য কোন পরিবেশবান্ধব উপায়ে উদযাপন করুন। মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনুস স্যারের কাছে আমার অনুরোধ থাকবে তিনি যেন আতশবাজি এবং ফানুস পোড়ানো কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন।


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এম. শহিদুল ইসলাম, ক্যাপসকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, এর আগে আতশবাজি নিয়ে গবেষণা করার কোন ইতিহাস বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে খুঁজে পান নাই। এই আতশবাজি পোড়ানোর কারণে মানুষের সাংস্কৃতিক বিপর্যয়, শারীরিক বিপর্যয় এবং জীববৈচিত্র্যের বিপর্যয় ঘটছে। তিনি নিজের একটি অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন যে, ৩১ ডিসেম্বর রাত বারোটা থেকে ২ টা পর্যন্ত তাকে নিজের ছাদে পাহারা দিতে হয় যেন কোন ফানুস এসে তার শখের  বাগানকে ধ্বংস করে না ফেলে। তিনি সকলকে অনুরোধ করে বলেন, “নতুন বছরে আমরা সবাই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হই, আমাকে যেন এই বছরেও রাত ১২টায় নিজের ঘুম নষ্ট করে বাগান পাহারা দিতে না হয়”


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বলেন, প্রকৃতিতে হস্তক্ষেপ করার পরিণতি কখনো ভালো হয় না। বায়ু দূষণের ফলে উদ্ভিদের খাদ্য উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। একটি এলাকার বায়ুদূষণ অথবা শব্দ দূষণের কারণে ওই এলাকার ইকো সিস্টেমে যত পোকামাকড় থাকে সেগুলো নিজেদেরকে বাঁচানোর জন্য অন্যত্র চলে যার কারণে উদ্ভিদের প্রজননের ক্ষেত্রেও একটি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। একটি আতশবাজি ফোটানোর কারণে যে এত বড় একটা প্রভাব বিস্তার করে সেটি আমাদের কল্পনারও বাইরে।


বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অফ প্ল্যানার্স এর সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান বলেন, নববর্ষ উদযাপনে আতশবাজি ও ফানুস পোড়ানোর প্রচলন যে সকল দেশ থেকে শুরু হয়েছিল তারাই এগুলো পোড়ানোর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। ফানুসের সাথে প্রেমিকার তুলনা না করে এর ক্ষতিকর দিকগুলো সবার সামনে তুলে ধরতে হবে। আতশবাজি না পুড়িয়ে দেশীয় সংস্কৃতি অর্থাৎ নাটক, মঞ্চ নাটক, গান, দেশীয় নাচ ইত্যাদির মাধ্যমে আমরা যেকোনো ধরনের দুর্ঘটনা এড়িয়ে গিয়েই আমাদের নববর্ষকে বরণ করতে পারি।


পরিবেশবিদ, গবেষক ও লেখক আশিকুর রহমান সমী বলেন, সবুজে ভরা বাংলাদেশে আমরা যোগ করেছি পৈচাশিক উদযাপনের সংস্কৃতি। আতশবাজি পোড়ানোর কারণে অনেক পাখি আতঙ্কে আকাশে উড়ে। গবেষণায় দেখা যায়, লক্ষ্মী পেঁচা একটি কৃষকের ২৫ লক্ষ টাকার ফসল রক্ষা করতে পারে। আমাদের স্কুল কলেজ থেকে শুরু করে সকল পর্যায়ে এ ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে যেন শিশুরা এবং তরুণরা বুঝতে পারে যে এই আতশবাজি ও ফানুস পোড়ানোর যে নেতিবাচক একটি দিক আছে।


সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী অ্যাড. রাশেদুজ্জামান মজুমদার বলেন, আতশবাজি আমদানি রপ্তানি করার ব্যাপারে বাংলাদেশে অনেক আগে থেকেই আইনের প্রচলন রয়েছে কিন্তু এর কোন সুষ্ঠু প্রয়োগ এখনো লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। কয়েক বছর ধরেই সরকারিভাবে এসবকে নিষিদ্ধ করে পরিপত্র জারি করা হচ্ছে। প্রায় প্রতিবছরই নববর্ষের সময়টাতে শত শত অভিযোগ কল আসে ৯৯৯-এ, কিন্তু এখন পর্যন্ত একজনকেও শাস্তির আওতায় আনা হয়নি। আইন কিংবা শুধুমাত্র নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দায় এড়ানোর প্রবণতা বন্ধ করে আমাদের আইনের প্রয়োগ করতে হবে।


আরন্যক ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক, ইন্সটিটিউশন অফ ফরেস্টার্স বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক রকিবুল হাসান মুকুল ক্যাপসকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, এটি একটি যুগান্তকারী গবেষণা। আমি ক্যাপসকে অনুরোধ করবো এই ধরনের গবেষণা চালিয়ে যেতে।


এছাড়াও উক্ত সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সংবাদকর্মী, সামাজিক ও পরিবেশবাদি বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরা।


সংবাদ সম্মলনে কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়:

1. দূষণ সৃষ্টিকারী আতশবাজি ও ফানুসের আমদানি, উৎপাদন, বিক্রয় ও সরবরাহে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে।

2. আতশবাজি এবং ফানুসের পরিবর্তে আলোকসজ্জা, প্রার্থনায় অংশগ্রহণ করা এবং সীমিত শব্দে দেশীয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের  মাধ্যমে করা যেতে পারে।

3. গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে পরিবেশ সুরক্ষার বার্তা ছড়ানোর জন্য ব্যবহার করতে হবে।

4. শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬ এবং অন্যান্য পরিবেশ সুরক্ষা আইনের কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

5. নববর্ষ উদযাপনের সময় পশু-পাখি এবং বন্যপ্রাণীর নিরাপত্তার জন্য সুরক্ষা পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

6. দূষণ নির্ধারণ এবং তার প্রভাব কমানোর জন্য গবেষণায় আরও বেশি তহবিল বরাদ্দ করতে হবে।