ডাকুস নির্বাচনে নজর থাকবে যাদের ওপর

ডাকুস নির্বাচনে নজর থাকবে যাদের ওপর

নানা জল্পনা-কল্পনার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) হল সংসদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে আগামী সেপ্টেম্বর। গত মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচনের তারিখ তফসিল ঘোষণা করেন ডাকসু নির্বাচনের প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন।

হিসেব বলছে, প্রায় ছয় বছর পর ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। সবশেষ  নির্বাচনে বেশির ভাগ পদে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের (বর্তমানে নিষিদ্ধ) প্যানেল থেকে জয় পেলেও সহসভাপতির (ভিপি) পদে জয়ী হয়েছিলেন কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা নুরুল হক নূর। সেই কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকেই গত বছর বাংলাদেশে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হয়। ছাত্র-জনতার তোপে পতন ঘটে আওয়ামী লীগের। আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের একটি অংশ এখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তারা বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নেতৃত্বে আছেন। তাই নতুন এই বাস্তবতায় ডাকসু নির্বাচনে কোন কোন ছাত্রসংগঠনের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে এবং কারা সম্ভাব্য প্রার্থী, তা নিয়ে ক্যাম্পাসের রাজনীতিসচেতন শিক্ষার্থীদের কৌতূহল রয়েছে।

নেই বয়সের বাধা

সর্বশেষ ডাকসু হল সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১৯ সালে। ২৮ বছর পর অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে প্রার্থীর সর্বোচ্চ বয়স ছিল ৩০ বছর। আসন্ন ডাকসু নির্বাচনে প্রার্থীর সর্বোচ্চ বয়সসীমা তুলে দেওয়া হয়েছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণকালীন শিক্ষার্থী হলেই নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া যাবে।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তমতে, এবারের নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না সান্ধ্যকালীন কোর্সের শিক্ষার্থীরা। ডাকসু হল সংসদ নির্বাচনে ভোটার প্রার্থী হতে হলে শিক্ষার্থীকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণকালীন শিক্ষার্থী হতে হবে, যিনি ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে স্নাতক প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়ে স্নাতক, স্নাতকোত্তর বা এমফিলে অধ্যয়নরত এবং কোনো আবাসিক হলে অবস্থানরত বা সংযুক্ত।

তা ছাড়া ছাত্রত্ব না থাকলে ডাকসু নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা। আইনি জটিলতা এড়াতে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ডাকসু নির্বাচন আয়োজনে গঠিত নির্বাচন কমিশন।

এবারের ডাকসু নির্বাচন সামনে রেখে ছাত্রসংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে গুরুত্বপূর্ণ একটি দাবি ছিল হলের বাইরে ভোটকেন্দ্র করা। সেই দাবি মেনে ডাকসু নির্বাচনে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোর বাইরে ভোটকেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়েছে।

কেন্দ্রগুলো হলো:

এক. কার্জন হল কেন্দ্র (পরীক্ষার হল); . মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্হল, অমর একুশে হল ফজলুল হক হলের শিক্ষার্থীরা এখানে ভোট দেবেন। দুই. শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্র; জগন্নাথ হল, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের শিক্ষার্থীরা এখানে ভোট দেবেন। তিন. ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি); রোকেয়া হল, শামসুন নাহার হল কবি সুফিয়া কামাল হলের শিক্ষার্থীরা এখানে ভোট দেবেন। চার. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব কেন্দ্র; বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হল শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের শিক্ষার্থীরা এখানে ভোট দেবেন। পাঁচ. সিনেট ভবন কেন্দ্র (অ্যালামনাই ফ্লোর, সেমিনার কক্ষ, ডাইনিংরুম); স্যার এফ রহমান হল, হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল বিজয় একাত্তর হলের শিক্ষার্থীরা এখানে ভোট দেবেন। ছয়. উদয়ন স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্র; সূর্যসেন হল, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল, শেখ মুজিবুর রহমান হল কবি জসীমউদ্দীন হলের শিক্ষার্থীরা এখানে ভোট দেবেন।

যে পরিকল্পনায় এগোচ্ছে ছাত্রসংগঠনগুলো

তফসিল ঘোষণার পর ছাত্রসংগঠনগুলোর নিজেদের মধ্যে প্রার্থী নিয়ে জোর আলোচনা শুরু হয়েছে। কাকে কোন পদে প্রার্থী করলে জয় ছিনিয়ে আনা যাবে, চলছে সেসব বিশ্লেষণ। তবে অধিকাংশ ছাত্রসংগঠনের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবার দলীয় প্যানেলের চেয়ে সম্মিলিত সাধারণ শিক্ষার্থী প্যানেলের কথা ভাবছে সংগঠনগুলো। নিজ সংগঠনের বাইরে স্বচ্ছ ভাবমূর্তির অনেক প্রার্থীকে তারা নিজেদের প্যানেলে রাখতে চাচ্ছেন।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর হওয়া ডাকসু নির্বাচনে শিক্ষার্থীরা অভ্যুত্থানে অবদান রাখা প্রার্থীদের কিছুটা এগিয়ে রাখবেনএমনটা মনে করছে কিছু সংগঠন। ছাড়া নারী শিক্ষার্থী, বিজ্ঞান অনুষদগুলোর শিক্ষার্থী, আদিবাসী, সংখ্যালঘু অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের ভোট প্রার্থীদের জিতে আসার জন্য বড় ভূমিকা রাখবে বলেও মনে করা হচ্ছে।

জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের প্যানেল কেমন হবে, তা দলীয় সিদ্ধান্তের আলোকেই ঠিক করা হবে বলে জানিয়েছেন সংগঠনটির নেতারা। বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ সম্মিলিত সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্যানেল করবে, এমন আলোচনা চলছে। বাম ছাত্রসংগঠনগুলোর পাশাপাশি ইসলামী ছাত্রশিবিরও পৃথকভাবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে প্যানেল দিতে পারে এমন আলোচনা হচ্ছে।

প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় যারা

ডাকসু নির্বাচনে সহসভাপতি (ভিপি), সাধারণ সম্পাদক (জিএস), সহসাধারণ সম্পাদকসহ (এজিএস) এবার মোট ২৮টি পদের বিপরীতে লড়বেন প্রার্থীরা। ছাত্রসংগঠনগুলোর দাবির মুখে এবার গবেষণা প্রকাশনা সম্পাদক; ক্যারিয়ার উন্নয়ন সম্পাদক; স্বাস্থ্য পরিবেশ সম্পাদক এবং মানবাধিকার আইনবিষয়ক সম্পাদক নামে চারটি নতুন পদ তৈরি করা হয়েছে।

ছাত্রসংগঠনগুলোর শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা এবং জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পরিচিত কিছু মুখ সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় রয়েছেন। জুলাই অভ্যুত্থানের পর গঠিত হওয়া সংগঠন গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বায়ক আবু বাকের মজুমদার, সদস্যসচিব জাহিদ আহসান মুখ্য সংগঠক তাহমিদ আল মুদ্দাসির চৌধুরী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক আবদুল কাদের প্রার্থী হতে পারেন। আলোচনায় রয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র উমামা ফাতেমা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সভাপতি মহিউদ্দিন মুজাহিদও।

ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবিদুল ইসলাম খান বি এম কাওসার, কবি জসীমউদ্দীন হল শাখা ছাত্রদলের প্রচার সম্পাদক তানভীর বারী হামিম প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় রয়েছেন।

বাম ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মেঘমল্লার বসু বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রীর জাবির আহমেদের নাম আলোচনায় রয়েছে। ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি আবু সাদিক কায়েম বর্তমান সভাপতি এস এম ফরহাদ প্রার্থী হতে পারেন। ছাড়া ছাত্র অধিকার পরিষদের বিন ইয়ামিন মোল্লার নামও আলোচনায় রয়েছে।

 

কে কী বলছেন

নির্বাচন আয়োজনে কালক্ষেপণের অভিযোগ ছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে। এরপরও তফসিল ঘোষণায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কিছুটা তড়িঘড়ি করেছে বলে মনে করছেন ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন।

নাহিদুজ্জামান বলেন, ‘অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলেছিল নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত হলে এবং শিক্ষার্থী নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত চিহ্নিত ছাত্রলীগ কর্মী ফ্যাসিবাদের দোসর শিক্ষকদের বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার পর তফসিল ঘোষণা করা হবে। কিন্তু আমরা সেগুলোর কিছুই দেখিনি। ডাকসুর গঠনতন্ত্র সংস্কারের বিষয়েও কোনো প্রকার অগ্রগতি দেখিনি।

ডাকসু নির্বাচন নিয়ে ইতিবাচক পদক্ষেপ শিক্ষার্থীদের মধ্যে উচ্ছ্বাস-উদ্দীপনার সঞ্চার করেছে বলে মনে করছেন গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক আবদুল কাদের। তিনি বলেন, ‘এই উচ্ছ্বাস যেন আশাহত অবস্থায় রূপ না নেয়, সে জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সচেষ্ট থাকতে হবে। কুচক্রী মহলের ডাকসু বানচালের পাঁয়তারায় প্রশাসনের মধ্যে যেন জুজুর ভয় সঞ্চারিত না হয়, সেটাই আমাদের আহ্বান থাকবে।

ডাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছেন ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সভাপতি আবু সাদিক কায়েম। তিনি বলেন, ‘প্রতিটি ক্যাম্পাসে ছাত্র সংসদের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব নির্বাচন করা জুলাইয়ের অন্যতম আকাঙ্ক্ষা। আমাদের দাবি থাকবে, অনতিবিলম্বে প্রতিটি ক্যাম্পাসেই যেন ছাত্র সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়।