ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াই; এক বছর পরও তারুণ্যের হৃদয়ে প্রতিবাদের আগুন
তানজীম নাঈম, আজ ০৬ জুলাই, ২০২৫। ঠিক এক বছর আগের এই দিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অগ্নিঝরা দিন হিসেবে চিরদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ২০২৪ সালের ৪ জুলাই ছিল বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতি ও ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসে এক অনন্য এবং স্মরণীয় অধ্যায়। সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটাসহ সকল ধরনের কোটা বাতিলের দাবিতে সেদিন দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেন পরিণত হয়েছিল প্রতিবাদের মঞ্চে। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রে হাজার হাজার শিক্ষার্থী মিছিল, অবস্থান কর্মসূচি ও বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিল। কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার থেকে শুরু হয়ে রাজু ভাস্কর্য, শাহবাগ, টিএসসি, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, প্রেস ক্লাবসহ পুরো এলাকা জুড়ে ছিল শিক্ষার্থীদের বজ্রকণ্ঠ স্লোগান—“কোটা নয়, চাই মেধার মর্যাদা”, “আমার অধিকার, আমি নেব”, “বৈষম্যের কোটা চাই না”, “একটাই দাবি, সমান অধিকার চাই”।
সেদিন শুধু ঢাকা নয়, দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, এমনকি জেলা শহরেও সেই আন্দোলনের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে দেশের প্রায় প্রতিটি বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা একযোগে রাস্তায় নামে। ঢাকার বাইরেও অনেক জায়গায় সড়ক অবরোধ, অবস্থান কর্মসূচি, মানববন্ধন আর প্রতিবাদ মিছিলে উত্তাল হয়ে ওঠে জনপদ।
শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল—সরকার যেন অবিলম্বে ২০১৮ সালের কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত বহাল রাখে এবং নতুন করে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ফিরিয়ে নেওয়া হয়। তাদের মতে, চাকরিতে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগই দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথ খুলে দিতে পারে। তারা প্রশ্ন তোলে, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মান থাকলেও প্রজন্মের নামে কোটা দিয়ে বারবার চাকরির সুযোগ তৈরির নামে বৈষম্য কেন?
তবে সেদিনের আন্দোলন কেবল শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বিভিন্ন স্থানে পুলিশের বাধা, ছাত্র সংগঠনের হামলা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের খবরও ছড়িয়ে পড়ে। অনেক জায়গায় বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশ লাঠিচার্জ করে, টিয়ারশেল ছোড়ে এবং গ্রেপ্তার করে, যার ফলে আহত হন বহু শিক্ষার্থী। সেই দিনের রক্তাক্ত ছবি, আহত শিক্ষার্থীদের আর্তনাদ আর প্রতিবাদের দৃশ্য সারাদেশকে নাড়া দিয়েছিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে সেই ভিডিও ও ছবি, যা দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও জায়গা করে নেয়। সেদিনের সেই আন্দোলন পরিণত হয়েছিল এক ঐতিহাসিক ছাত্র-জনতার জাগরণে।
এক বছর পর, আজ ২০২৫ সালের ৪ জুলাই, সেদিনের স্মৃতি আজও তরুণদের মননে-চেতনায় অমলিন। সারাদেশে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আজও স্মরণ করা হচ্ছে সেই প্রতিবাদের দিনটিকে। অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করছেন, কেউ মোমবাতি জ্বালিয়ে স্মরণ করছেন সেই দিনের শহীদ ও আহতদের, আবার কেউ লিখছেন, “আমরা ছিলাম সেই ইতিহাসের অংশ, এই দিন আমাদের অধিকার আদায়ের প্রতীক।” ঢাকায় বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন আজ স্মরণসভা, আলোচনা সভা, পোস্টার প্রদর্শনী ও প্রতিবাদী গান পরিবেশনের মাধ্যমে দিবসটি পালন করছে।
তবে প্রশ্নও উঠছে—এক বছর পেরিয়ে গেলেও কি আদৌ সেই আন্দোলনের দাবিগুলো পূরণ হয়েছে? অনেকে বলছেন, এখনো সরকার সেই সিদ্ধান্ত পুরোপুরি কার্যকর করেনি, বরং নানা কৌশলে বিষয়টি ঝুলিয়ে রেখেছে। তাই অনেক তরুণের মনে ক্ষোভ ও হতাশা—তাদের আন্দোলন, ত্যাগ ও রক্ত কি তবে বৃথা যাবে?
তবুও ৪ জুলাইয়ের সেই আন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অমর ঘটনা হিসেবে থেকে যাবে। এটি শুধু একটি আন্দোলন নয়, ছিল নতুন প্রজন্মের অধিকার সচেতনতার জাগরণ, ছিল মেধার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, ছিল তারুণ্যের ঐক্যের প্রতীক। আজকের এই দিনে আবারও দেশের আকাশ-বাতাসে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সেই ঐতিহাসিক স্লোগান—“কোটা নয়, চাই মেধার মর্যাদা।”
লেখক: শিক্ষার্থী, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চবি
(এটি সম্পুর্ন লেখকের নিজস্ব মতামত)
