যে পথেই চলুন নিজেকে জানান দিন
মোহাম্মদ আলি। বক্সিং ইতিহাসের সর্বকালের সেরা হিসেবে বিবেচিত। আমেরিকান প্রাক্তন প্রফেশনাল ও কিংবদন্তি এই বক্সারের বিভিন্ন সাক্ষাৎকার থেকে অনুপ্রেরণার কথা তুলে এনেছেন আয়শা সিদ্দিকা
ক্যারিয়ারের একেবারে প্রথম ম্যাচ থেকে, যার বিপক্ষেই লড়ছি না কেন, হুঙ্কার ছুড়ে দেওয়াটা আমার অভ্যাসে পরিণত হয়। এভাবেই দর্শকদের আশ্বস্ত করতাম–আমি হারতে আসিনি। যখন আমি আর সেই পুঁচকে বক্সারটি নেই, লোকজন তখন টাকা খরচ করে আমার সেই হুঙ্কার দেওয়া ভঙ্গিমার ছবি ছাপা হওয়া ড্রয়িং কার্ডগুলো দেদার কিনত। অন্যরাও যে এত এত বক্সিং খেলছে, কেউ হারছে, কেউ জিতছে; সেদিকে যেন তাদের কোনো খেয়ালই নেই! ব্যাপারটা এমন, যেন আমি তাদেরই লোক। কেউ কেউ হয়তো ভেবে বসেছে, প্রকৃত বয়সের চেয়ে আমি যেন বছর দশকের বড়। যতদিন দর্শক আমার লড়াই দেখতে এসেছে, এসব ব্যাপারে একদম মাথা ঘামাইনি আমি।
স্কুলে পড়া ছোট্ট বালকটি...
যখন স্কুলে পড়া ছোট্ট বালকটি ছিলাম তখন অবাক হয়ে দেখতাম, ভিন্ন ধরনের আচরণকারী মানুষের প্রতি অন্যদের কী দারুণ আগ্রহ! স্কুল বাসে উঠতাম না আমি; বরং সেটির পাশ দিয়ে দৌড়ে ছুটতাম। বাকি শিশুরা আমার দিকে হাত নেড়ে চিৎকার করে উঠত আর আমাকে ‘পাগল’ ডাকত। এভাবেই বিশেষ কেউ হয়ে উঠি আমি!
উপহারের বাইসাইকেল
১২তম জন্মদিনে উপহার হিসেবে একটা বাইসাইকেল পেয়েছিলাম। সেটিতে চেপে গিয়েছিলাম কলাম্বিয়া জিমনেসিয়ামের এক মেলায়। মেলা থেকে বেরিয়ে দেখি, বাইসাইকেলটা চুরি হয়ে গেছে। দুঃখে পাগলের মতো কাঁদতে শুরু করি। জো মার্টিন নামে এক পুলিশকে কাছে এলে জানালাম, যে আমার বাইসাইকেল চুরি করেছে, তাকে পেলে আচ্ছামতো ধোলাই দেব! তিনি বললেন, চোর ধোলাই দিতে খানিকটা বক্সিং প্র্যাকটিস করে নিলে ভালো হবে আমার জন্য। তাঁর কথা মানলাম। শুরু করলাম ফাইটিং। এর মাস দেড়েক পর নিজের প্রথম ফাইট জিতলাম সমবয়সী একটা শ্বেতাঙ্গ ছেলের বিপক্ষে। এক বছরের মধ্যে টেলিভিশনে সম্প্রচারিত হতে থাকল আমার লড়াই। জো মার্টিন বুদ্ধি দিয়েছিলেন, আমি যেন ক্লাবগুলোর ফাইটে অংশ নিই। এক বছর তা-ই করার পর তিনি বললেন, অলিম্পিকের জন্য চেষ্টা চালানো উচিত।
শ্বেতাঙ্গদের অধিকার
জানি, যখন খেলা শুরু করি, তখন রিংয়ের পাশের আসনটিতে বসার অলিখিত অধিকার শুধু শ্বেতাঙ্গদেরই ছিল। ফলে আমাকে পাগলাটে আচরণ করতেই হতো। বলতে হতো, ‘আমি সর্বকালের সেরা। আমি সুন্দর। জো মার্টিনকে বলে দিও, আমিই জিতব।’ সামনের সারির দর্শকরা বলত, ‘নিগ্রোটা বেশি কথা বলে!’ ফলে, ‘আমিই শ্রেষ্ঠতম’- একজন কালো মানুষের এমন দাবিকে সত্য করতে নিজেকে তুখোড় করে তুলতেই হতো আমাকে। ব্যাপারটা এমন ছিল, যেন কালোদের নিয়তিতে দুর্ভোগই শ্রেয়। তিনশ বছর ধরে কালোদের এমন দুর্গতি। কলেজে গেলেই শুনবেন, কালোরা খারাপ; যা ভালো–সব শ্বেতাঙ্গ। ফলে, একজন কালো মানুষ হিসেবে ‘আমিই শ্রেষ্ঠতম, আমিই সুন্দর’–এ দাবি ছিল আমার স্পর্ধা।
আয়েশি কোনো ব্যাপার ছিল না জীবনে
শহরতলিতে, কোনো আকাশছোঁয়া হোটেলে বাস করার মতো পর্যাপ্ত টাকা আমার হয়েছিল। হোটেলের পেনহাউসে, রুমভর্তি বন্ধুবান্ধব নিয়ে আয়েশ করা ব্যাপার ছিল না আমার জন্য। আমি তার কোনোটিই করতে চাই না। বরং খেটে খাওয়া শ্রমিকদের প্রতিবেশী হয়ে জীবন কাটাতেই ভালো লাগে। আপন মানুষদের কাছাকাছি থাকার আনন্দই আলাদা। নিজের অভ্যস্ত পরিমণ্ডলে জীবন কাটানোর এই প্রচেষ্টা মানুষের এক সহজাত প্রবণতা। আমি কোনো ঝামেলা চাই না। যে মানুষদের ভেতর বেড়ে উঠেছি আমি, বিখ্যাত ও অর্থবান হয়ে যাওয়ার পর কেন ছেড়ে যাব তাদের? আমি চেয়েছি, নিজেদের তুচ্ছ ভাবা কালো শিশুগুলো গর্ব করে বলুক–‘আমাদের লোকটাই চ্যাম্পিয়ন। দেখ, সে কী করছে! দেখ, সে কীভাবে কাটাচ্ছে জীবন।’ Source: Samakal
