১০ বছর আগের অবস্থানে রিজার্ভ
দেশে চলমান ডলার সংকটের উত্তরণ না হওয়ায় দিন দিন কমে যাচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ। ফলে অব্যাহত রয়েছে রিজার্ভের পতন। কমতে কমতে এটি ১০ বছর আগের অবস্থানে নেমে এসেছে। দুই বছর ধরে আমদানির লাগাম টেনেও পরিস্থির উন্নতি হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) মাধ্যমে মার্চ-এপ্রিল দুই মাসের ১ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন বা ১৬৩ কোটি ডলার আমদানি বিল নিষ্পত্তির পর গতকাল সোমবার রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৮ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলারে। তথ্য বলছে, ২০১৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ১৮ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ আকু পেমেন্টের ফলে ১০ বছর আগের অবস্থানে নেমে গেছে দেশের রিজার্ভ।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘ঈদ সামনে রেখে মার্চ ও এপ্রিল মাসে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। রমজানে অন্য সময়ের তুলনায় কিছু পণ্যের চাহিদা ব্যাপক বেড়ে যায়, সেগুলো আমদানি করতে হয়। সে কারণে গত দুই মাসে আকুর পেমেন্টের পরিমাণ কিছুটা বেড়েছে।’
অন্যদিকে প্রকৃত ব্যয়যোগ্য রিজার্ভ (নিট রিজার্ভ) দাঁড়িয়েছে ১৩ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার। আগামী জুন শেষে এ অঙ্ক ১৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়নে উন্নীত করার লক্ষ্য ঠিক করে দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, মার্চ-এপ্রিল এই দুই মাসের জন্য আগের মাসের তুলনায় বেশি করতে হয়েছে আকুর পেমেন্ট। কারণ হচ্ছে, রমজান ও ঈদের কারণে বেশকিছু পণ্যের আমদানি বেড়ে গেছে। এর আগে চলতি বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি সময়ের জন্য আকু বিল বাবদ পরিশোধ করতে হয়েছিল ১ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলার। সে সময় এ দায় পরিশোধের পর দেশের রিজার্ভ কমে দাঁড়ায় ২০ বিলিয়ন ডলারের ঘরে।
জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘দেশের রিজার্ভে বৈদেশিক মুদ্রা যেসব উৎস থেকে আসে ও ব্যয় হয়Ñ এ দুটোর মধ্যে ভারসাম্য নেই। ফলে রিজার্ভ ধরে রাখা যাচ্ছিল না।’
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি নিয়ন্ত্রণ করায় বাণিজ্য ঘাটতি কিছুটা কমেছে। তবে এভাবে ধরে রাখাটা কতদিন সম্ভব হবে তা নিয়ে সন্দেহ আছে। আমদানি নিয়ন্ত্রণের ফলে দেশের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, যার ফলে রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের মার্চে আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলার পরিমাণ ছিল ৬ বিলিয়ন ডলারেরও কম। গত বছর মাত্র তিনবার এলসি খোলার পরিমাণ ৬ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। অর্থাৎ রিজার্ভের পতন ঠেকাতে আমদানির লাগাম টেনে ধরা হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, বেসরকারি ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়কালে ৪৪ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলারের এলসি নিষ্পত্তি করেছে, যা এক বছর আগের একই সময়ের চেয়ে ১৩ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলার কম। আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে ব্যয় হয়েছিল ৫১ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার।
নিট রিজার্ভ ১৩ বিলিয়নে
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে, গত ৮ মে বিপিএম-৬ পদ্ধতি অনুযায়ী দেশের রিজার্ভ ছিল ১৯ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার। গতকাল আকু পেমেন্টের পর এটি আরও কমে ১৮ দশমিক ২৬ বিলিয়নে নেমে আসে। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশের নিট রিজার্ভের হিসাব প্রকাশ না করলেও গত মাসে তা ১৪ দশমিক ০৭ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। গতকাল আকু পেমেন্টের পর প্রকৃত ব্যয়যোগ্য রিজার্ভ (নিট রিজার্ভ) ১৩ বিলিয়নের ঘরে নেমে আসে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে ব্যয়যোগ্য নিট রিজার্ভ রয়েছে ১৩ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার। আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণের শর্ত অনুযায়ী যে রিজার্ভ রাখার কথা, এ পরিমাণ তার চেয়ে কম। ঋণদাতা সংস্থাটি জুনের জন্য নিট রিজার্ভ ১৪ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার রাখার লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছে। আগে এ লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২০ দশমিক ১০ বিলিয়ন ডলার।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের অন্তত তিন মাসের আমদানি খরচ মেটানোর সমপরিমাণ ব্যয়যোগ্য রিজার্ভ থাকতে হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের তিন মাসের খরচ মেটাতে প্রয়োজন অন্তত ১৫ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ তিন মাসের খরচ মেটানোর জন্য প্রয়োজনীয় ডলার মজুদ নেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা আশা করছেন, চলতি মাসের শেষদিকে বা আগামী মাসের শুরুতে আইএমএফের ঋণের তৃতীয় কিস্তি বাবদ ১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার পাওয়া গেলে রিজার্ভ ফের বাড়বে।
রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি
দীর্ঘ সময় ধরে দেশের ডলার বাজারে অস্থিরতা চলছে। প্রয়োজনীয় এলসি খুলতে পারছে না অনেক ব্যাংক। বকেয়া দায় পরিশোধ করতে হিমশিম খাচ্ছে অনেকে। এমন পরিস্থিতি সামাল দিতে এবং রাষ্ট্রীয় জরুরি পণ্যের এলসি নিষ্পত্তিতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতি ঘোষণাকালে ডলার বিক্রি বন্ধের কথা জানিয়েছিলেন। কিন্তু বিক্রি বন্ধ হয়নি। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের ১০ মাসেই রিজার্ভ থেকে ১১ বিলিয়নের বেশি ডলার বিক্রি করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে ১৩ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছিল। তার আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে ডলার বিক্রি করেছিল ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার।
এ প্রসঙ্গে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘নীতিগত ভুলের কারণে ডলার বাজারে যে সংকট তৈরি হয়েছে, তাতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে বিকল্প ছিল না। জরুরি এলসি নিষ্পত্তির জন্য বাধ্য হয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে এখনও। তাই ডলারের সরবরাহ বাড়াতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।’
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘ডলারের সরবরাহ বাড়াতে হলে পাচার বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি রেমিট্যান্স বাড়াতে হুন্ডির লাগাম টানতে হবে। একই সঙ্গে দক্ষ কর্মী বিদেশে পাঠাতে হবে। তাছাড়া রপ্তানি আয় বাড়াতে দীর্ঘমেয়াদি টেকসই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’
তিনি বলেন, রপ্তানি বহুমুখীকরণে পদক্ষেপ নিতে হবে। অর্থাৎ কেবল পোশাকের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে রপ্তানিতে নতুন নতুন পণ্য যোগ করতে হবে। আর ইউরোপ-আমেরিকার বাজারের বিকল্প হিসেবে নতুন বাজার খুঁজে বের করতে হবে। তাছাড়া রপ্তানি আয়ের সব অর্থ দেশে আনতে পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দেন এই অর্থনীতিবিদ।সুত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন
